যুদ্ধ কেন

বই পর্যালোচনাঃ যুদ্ধ কেন 

যুদ্ধ কেন। আলবার্ট আইনস্টাইন ও সিগমুন্ড ফ্রয়েড। অনুবাদ: শ্যামল ঘোষ।৩২ পৃষ্ঠা। প্রথম প্রকাশ: সেপ্টেম্বর ২০০৫। প্রকাশক: শিবব্রত গঙ্গোপাধ্যায়, চিরায়ত প্রকাশন প্রাইভেট লি: কলকাতা। মুদ্রাকর: এস এস প্রিন্ট কলকাতা। দাম: ২০ টাকা।

কবি জহর সেন মজুমদারের একটা উদ্ধৃতি দিয়ে ‘যুদ্ধ কেন’ বইটির প্রসঙ্গে ঢুকি। ২০১৯ সালে বিকাশরঞ্জন পাইককে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে  বলেছিলেন,  “আমরা যেসব মানুষ দেখি,তার বহুরূপ; আমরা যে জীবনের মধ্যে বসবাস করি— তারও বহুরূপ; প্রত্যক্ষে প্রতিনিয়ত দেখতে দেখতে মনে হয়, চিনে ফেলেছি; কিন্তু সত্যিই কি তাই? চেনা যা, মুহুর্তে তা অচেনা; আমি বারবার ঠিক এই চেনা-অচেনা দ্বান্দ্বিক দ্বিরালাপে সর্বদা নোঙর ফেলে বসে আছি; যা চেনা, যা স্পষ্ট এক প্রকাশ সেই মানুষে সেই জীবনের পদচারণা করতে করতে ক্রমশ এই দৈনন্দিন বাস্তবতার প্রতি কেমন যেন একটা অনীহা ও বিবমিষা তৈরি হয়ে যায়; চারপাশে এত রক্ত কেন? এত মল মূত্র পুঁজ কেন? এত ঘৃণা বমি রিরংসা কেন?…

জীবনের এই প্রচুর অচিকিৎস্য ব্যাধির ভেতর সুধীন্দ্রনাথের উটপাখির মতো মুখ গুঁজে পড়ে থাকতেই হয়; আর ফাটা ডিমে তা দিতে দিতে, ধূ ধু মরুভূমি ভেতর,আবার প্রবল স্বপ্নযন্ত্রণা  নিয়ে  জীবনেরই কাঠামো নতুন করে ভাবতে শুরু করি; এই ভাবনা শুধু আমার নয়; তোমার আমার সকলের; ঠিক এরকম এক সঙ্গকটদীর্ণ আত্মরতি থেকেই একটা সময় ‘লাইফ ইট ইজ টু বি-র দিকেই শুরু হয় টানা সন্মোহিত অভিযাত্রা…”

এবার আসি ‘যুদ্ধ কেন’ বইটি প্রসঙ্গে

আইনস্টাইনের যুদ্ধ-বিরোধী অবস্থান সবাই জানেন। সমগ্র পৃথিবীর মানুষের যুদ্ধ বিরোধী আবেগকে সংগঠিত করে বিজ্ঞানী আইনস্টাইন নেতৃত্ব দেবার প্রয়াস চালিয়েছেন। তারও আগে তাঁর মনে হয়েছে মানুষ কেন, কখন যুদ্ধে লিপ্ত হতে চায় তার কারণ অনুসন্ধান জরুরি। উৎস বা কারণ আবিষ্কার করা গেলে হয়তো যুদ্ধ বন্ধ করা সহজ হতে পারে। মানুষের যুদ্ধ-উন্মাদনায় লিপ্ত হওয়ার পিছনে কি মনো-বৈজ্ঞানিক কারণ ও অবস্থান রয়েছে তা জানতে প্রখ্যাত মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েডের দ্বারস্থ হয়েছেন তিনি। চিঠি লিখেছেন ফ্রয়েডকে। ফ্রয়েডকে ভরসা করার কারণ হিসেবে চিঠির এক জায়গায় তিনি বলেছেন—আমি মনে করি আপনার বাস্তববোধ অন্য অনেকের মতো জেগে স্বপ্ন দেখার বিলাসিতায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়নি। আপনি একাধারে সূক্ষ্ম বিচার-বুদ্ধি, আন্তরিকতা ও দায়িত্ববোধের প্রতিমূর্তি।

আইনস্টাইনের অনুরোধেই মানুষের যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার  একনায়কী বা জনগোষ্ঠীগত মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করেছেন ফ্রয়েড।

১৯৩৩ সালে “যুদ্ধ কেন?”  এই শিরোনামে যখন আইনস্টাইন এবং ফ্রয়েডের চিঠিপত্র প্রকাশিত হচ্ছে হিটলার তখন জার্মানিতে ক্ষমতা দখল করেছে। দুজনই হিটলারের নির্বাসন তালিকাভুক্ত ছিলেন। যে-কারণে চিঠিপত্রগুলো যে ধরনের প্রচার পাওয়ার কথা ছিল ওই সময়ে তা হয়ে ওঠেনি। দু’জন বিচক্ষণ মানুষের এই পত্রালাপ দেশ-কালের সীমায় সীমাবদ্ধ নয়। দেশে-দেশে, জাতিতে-জাতিতে, ধর্মাধর্মে, স্ব-জাতিতে অবিরত ধ্বংস আর সংঘর্ষ যখন থেমে নেই, তখন পত্রালাপের মধ্যে যুদ্ধ না থামার কারণ হিসেবে মানুষের সহজাত যে বৈশিষ্ট্যগুলো উঠে এসেছে তা সমগ্র যুদ্ধবিরোধী মানুষের জন্য একরকম স্বান্ত্বনা নিয়ে হাজির হতে পারে।

আইনস্টাইনের পক্ষ থেকে প্রস্তাবনা, প্রশ্ন ও অভিব্যক্তি

আইনস্টাইনের চিঠিতে যেসমস্ত প্রস্তাবনা আর প্রশ্নের উল্লেখ ছিল এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসবের প্রেক্ষিতে তাঁর নিজের যে চিন্তা ও অভিব্যক্তি উঠে এসেছে তা  সংক্ষেপ মোটামুটি এমন—

প্রথমত তিনি বুদ্ধিজীবী ও স্ব স্ব ক্ষেত্রে যারা সন্দেহাতীতভাবে সাফল্য পেয়েছেন এমন মনীষীদের নিয়ে মহাজোট পরিকল্পনার কথা ভেবেছেন।পরবর্তী পর্যায়ে বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও এমন সব মহান ব্যক্তিদের কথা ভেবেছেন যাদের সদিচ্ছায় কোনো প্রশ্ন নেই, কিন্তু নিস্পৃহ তারা নৈতিক বল হিসেবে কাজ করবে। এই মহাজোট  লিগ অব নেশনসের যে সকল সদস্যগণ লিগের প্রকৃত লক্ষ্য অর্জনে নিরলস প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন তাদেরও নৈতিক ভরসাস্থল হয়ে উঠতে পারে এমন বাসনা ব্যক্ত করেন।

এমন প্রস্তাবনার নেপথ্যের ভাবনা হিসেবে তিনি মনে করেন, সবসময় মানবজাতির ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের ভার অনিবার্যভাবে দায়িত্বজ্ঞানহীন রাজনৈতিক নেতৃত্বের হাতে সমর্পিত হয়েছে। রাজনৈতিক নেতা বা সরকারগুলির ক্ষমতার উৎস হয়  বাহুবল না হয় গণতান্ত্রিক নির্বাচন। তাদের কোনোমতেই অধিকতর নৈতিক গুণসম্পন্ন পন্ডিতদের প্রতিনিধি বলে মেনে নেওয়া যায় না। বর্তমানে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবীরা পৃথিবীর ইতিহাসে কোনও প্রত্যক্ষ প্রভাব বিস্তার করতে পারছেন না। এবং আমাদের এমন কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থা নেই যারা বিতর্কিত বিষয়ে পূর্ণ কর্তৃত্ব নিয়ে পক্ষপাতহীন মীমাংসা করতে এবং সকল রাষ্ট্রকে তাদের রায় মানতে বাধ্য করতে পারে।

প্রত্যেক রাষ্ট্রেই শাসক শ্রেণির ক্ষমতা লিপ্সাই জাতীয় সার্বভৌমত্বের সীমারেখা টানার প্রধান অন্তরায়। এই রাজনৈতিক ক্ষমতালিপ্সায় আরও একটি শ্রেণি সমর্থন জোগায়। তাদের আশা- আকাঙ্ক্ষা পুরোপুরি অর্থনৈতিক কারণে চালিত হয়।  এই শ্রেণি সব দেশেই ভয়ংকরভাবে সক্রিয়। তাদের কাছে যুদ্ধ হচ্ছে অস্ত্রসস্ত্র উৎপাদন আর কেনাবেচার একটি উপলক্ষ্য যা তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থ, অর্থ ও প্রতিপত্তি বহুগুণ বৃদ্ধি করে। এই শ্রেণির লোকজন সামাজিক নিয়ন্ত্রণ, উন্নয়ন ও বিচার-বিবেচনা ইত্যাদি বিষয়ে সম্পূর্ণ উদাসীন। আইনস্টাইন এখানে  শাসক শ্রেণি এবং প্রচন্ড স্বার্থপর—সমাজ সম্পর্কে উদাসীন এই শ্রেণির সরল সত্যতাকে স্বীকার করে প্রকৃত ঘটনার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে বলেন।

তার পরপর যে প্রশ্নগুলো তিনি উত্থাপন করেন—

কেমন করে এই একটা ক্ষুদ্র গোষ্ঠী বাকি সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে নিয়ন্ত্রণ করে?

এমন কি ব্যাপার ঘটে যার ফলে মানুষ ভয়ংকর আবেগতাড়িত হয়ে নিজের জীবন বলিদান করতে বিচলিত হয় না?

আমাদের কি মানুষের মনকে ঘৃণা ও ধবংসাত্মক প্রবৃত্তি থেকে মুক্তি দেয়া সম্ভব?

প্রথম প্রশ্নের প্রেক্ষিতে তাঁর নিজের ব্যাখ্যা যুদ্ধের ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠই ক্ষতিগ্রস্ত বেশি হয়। বর্তমান শাসক শ্রেণি  সংখ্যায় সামান্য হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, সংবাদ মাধ্যম এবং সাধারণভাবে চার্চকে নিয়ন্ত্রণ করে; ফলে জনগণের বৃহত্তর অংশের ভাবনা-চিন্তা, আবেগকে, নিয়ন্ত্রিত করতে তারা সংগঠিত প্রয়াস চালায়।

দ্বিতীয় আত্মউদ্ভুত প্রশ্নের জবাবে অনেকটা নিশ্চিতভাবেই  বলেন, মানুষের নিজের মধ্যেই ঘৃণা ও ধবংশের লালসা বিদ্যমান। স্বাভাবিক অবস্থায় এই প্রবণতাগুলো সুপ্ত থাকে, অস্বাভাবিক অবস্থায় প্রবণতাগুলো জাগ্রত হয়। তুলনামূলকভাবে দুষ্ট প্রবণতাগুলো জাগ্রত করে একটি গণ-হিস্টিরিয়া গড়ে তোলা অপেক্ষাকৃত সহজ।

শেষ প্রশ্নের ব্যাখ্যায় তিনি সাধারণ মানুষকে একপাশে সরিয়ে বুদ্ধিমান জনগোষ্ঠীর দিকে আঙ্গুল তাক করেন। বলেন, অভিজ্ঞতায় দেখা গিয়েছে যে অপেক্ষাকৃত বুদ্ধিমান জনগোষ্ঠীই সহজে আবেগতাড়িত হয়ে সর্বনাশা কর্মকাণ্ডে অগ্রণী ভূমিকা নিয়ে থাকে। কারণ বুদ্ধিজীবীরা সাধারণত চলমান  জীবনের গভীরতার সাথে সম্পর্কহীন। জীবনের মাধুর্য বেশিরভাগ সময়েই ছাপা হরফ থেকে আহরণ করতে হয়।

এক মানুষের সাথে আরেক মানুষের, এক জাতির সাথে আরেক জাতির, রাষ্ট্রের সাথে রাষ্ট্রের  বৈশ্বিকভাবে, শেষ পর্যন্ত যে সামরিক সংঘর্ষে উপনীত হয়, তা ঠেকানোর উপায় হিসেবে উদ্ভাবনী-কৌশল আবিষ্কার করতে চেয়েছেন, চেয়েছেন প্রকৃত প্রতিষ্ঠিত মনীষীদের নিয়ে তৈরি করতে মহাজোট। আন্তর্জাতিক সহমত সাপেক্ষে গড়ে তুলতে চেয়েছেন একটি আন্তর্জাতিক আইন ও বিচার বিভাগীয় সংস্থা। এই সংস্থাই জাতিতে-জাতিতে সংঘর্ষ মেটাতে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেবে। এমন অনেক ইচ্ছেকে বাস্তবায়ন ও লক্ষ্যে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে শক্তিশালী মনস্ত্বাত্বিক বাধাকেই আইনস্টাইন অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। আর ঠিক এ-জায়গাতেই শরণাপন্ন হয়েছেন মহান সিগমুণ্ড ফ্রয়েডের দরবারে।

ফ্রয়েড  যা বলেন

প্রশ্নের সাথে সাথে আইনস্টাইন নিজেই তার ব্যাখ্যাও দিয়ে দিয়েছেন বলে প্রথমেই মিষ্টি কটাক্ষ করেন ফ্রয়েড ‘’আমার পালের হাওয়া কেড়ে নিয়েছেন” এই বলে।

ফ্রয়েড আইনস্টাইনের ‘ক্ষমতা বা বাহুবল’’ এই শব্দটির পরিবর্তে ‘হিংসা’ শব্দটিকে যোগ করতে বলেছেন। তিনি মনে করেন হিংসার আঁতুড়ঘর হচ্ছে “অধিকারবোধ” অথবা বিপরীতভাবে অধিকারবোধের উৎপত্তি হিংসা থেকে।

আত্মনিরিখে: সম্পাদনা প্রসঙ্গ

আত্মনিরিখে: সম্পাদনা প্রসঙ্গ
তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে লোক প্রশাসন নিয়ে পড়াশুনা করি। বাম-রাজনীতি করি। আর দৈনিক পত্রিকায় পার্টটাইম কনট্রিবিউটর। চারুকলা, শিল্প ও বিশ্বসাহিত্য নিয়ে বিপুল আগ্রহ। শুধু লোক প্রশাসন পড়তেই ভালো লাগত না। ফলত ডিপার্টমেন্টের বাইরে গিয়ে কবি-শিল্পীরাই হয়ে গেল আড্ডার বন্ধু। তখনও চিঠিযুগ অবশিষ্ট ছিল। লেখালেখি-আঁকাআঁকি কাগজ-কলমেই চলত। জাতীয় পত্রিকায় কবিতা পাঠাই সম্পাদক বরাবরে দরখাস্ত লিখে খামে ভরে। শুক্রবারে শিল্প-সাহিত্যের পাতাগুলো প্রকাশিত হত। দৈনিকের মূল পাতাগুলোকে সরিয়ে রেখে শুধু সাপ্লিমেন্টারিগুলো দুই থেকে পাঁচ টাকায় চেরাগি পাহাড় মোড়ে গণির দোকান থেকে সংগ্রহ করতাম। তারপর আড্ডায় চলত কাঁটাছেড়া-বিশ্লেষণ। অমুক কবির তমুক লাইনটা ভালো, তমুক গদ্যটা ভালো, গল্পের গাঁথুনি দুর্বল ইত্যাদি। তবে আমাদের বেশিরভাগ সময়েই মনে হয়েছে কাগজ ভরানো আর প্রতিষ্ঠিত লেখকদের জন্যই দৈনিকের পাতা বরাদ্দ থাকে। সেখানে না-আছে নতুন কোনো নিরীক্ষা, না সমাজ-বাস্তবতা। ছোটো কাগজগুলিই অতীতের মতো বর্তমানের (তখনকার) এই অন্ধকার দূর করতে পারে। ততদিনে দৈনিক পত্রিকায় সম্পাদনার কাজেও জড়িয়েছি। টুকটাক অভিজ্ঞতা হয়েছে। মনে হল নিজেই একটি কাগজ বের করে ফেলি-না কেন!
নামও ঠিক করে ফেললাম, ‘ঘুড়ি’! ও বয়সে যেমন হয়! আকাশের বিশালতা আর আদিগন্ত উড়বার স্বাধীনতাই নাম নির্বাচনে প্রলুব্ধ করেছিল নিশ্চয়। ২০০৫ থেকে ২০১১ ঘুড়ির মোট ৭টি সংখ্যা বেরিয়েছিল। ৭টি সংখ্যা আজ ২০২৩-এ এসে নেড়েচেড়ে যখন দেখি বেশ কিছু উপলব্ধিতে আক্রান্ত হই। যদিও ফিরে দেখতে ভালো লাগে না। কিন্তু কখনো পরিবর্তনমানতার প্রবাহ কোথায় কতদিকে কতভাবে ধাবিত হল তা আবিষ্কার করা গেলে বর্তমান-চিন্তাকে বিচার-বিশ্লেষণ করতে সুবিধাই হয়।
1.4
ঘুড়ির প্রথম সংখ্যা যখন বেরিয়েছিল তখন রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত। জঙ্গিবাদের উত্থান আর সিরিজ বোমা হামলা সাধারণ ও মুক্তবুদ্ধির মানুষেদের ভীত-সন্ত্রস্ত করে রেখেছিল। সে-সময় শিল্প সাহিত্যে আমাদের কী ভূমিকা হতে পারে, মনে হল যার যা কাজ সেটা করাই একটা অর্থ হতে পারে হয়তো। সম্পাদকীয়তে লিখেছিলামও এরকম একটি লাইন, “ঘুড়ি এ-সময়ের সাহিত্যের ছোট কাগজ। সময়ের শৈল্পিক প্রকাশে ঘুড়ি তার স্বাধীনতায় উড়বে। সময় এবং স্বপ্ন যেহেতু কোনোটাই স্থির নয়, তাই কত দূরের আকাশ ঘুড়ি ছোঁবে— সে-ভারটি তোলা থাক নির্দোষ সময়ের কাছেই।”
এ-সমস্ত অনির্দিষ্ট স্বপ্নময় শব্দ-বাক্য এখন ঠিক এইভাবে আসে না। প্রথম সংখ্যায় বেশ কিছু গদ্য-কবিতা-গল্প সহ শিল্পী মনসুর-উল করিমের একটি সাক্ষাৎকারও নিয়েছিলাম। জীবনের প্রথম সাক্ষাৎকারটি নিতে গিয়েছিলাম চারুকলার বন্ধু লুসিফার লায়লার হাত ধরে। প্রচ্ছদ করে দিয়েছিলেন চারুকলার বড়ো ভাই সুদীপ্ত। পরে চারটি সংখ্যার প্রচ্ছদই তিনি করেছিলেন। প্রথম সংখ্যায় লেখক কারা হবেন এবং কী কী বিষয় থাকবে সেটাই একটা যুদ্ধ ছিল। পরিচিত লেখক বন্ধু-বান্ধব ছাড়া দূরের লেখক যাঁদের আমি চিনলেও আমায় চেনেন না, তাঁরা কেন লেখা দেবেন এটাও দুঃশ্চিন্তার বিষয় ছিল। সমস্ত দুঃশ্চিন্তাকে জয় করে লেখা জোগাড় করতেই প্রায় আধা বছরের বেশি সময় লেগে গেল। কিন্তু লেখাগুলো পড়ে খুব বেশি অসন্তুষ্ট হতে হয়নি তখনকার মতো এটা মনে আছে। লেখা তো হল, ছাপাছাপির দুনিয়ায় কাউকেই তো চিনি না। আলাউদ্দীন খোকন এগিয়ে এলেন। চেরাগি পাহাড় মোড়ে লুসাই ভবনে বসবাস করা মুক্তিযোদ্ধা রমা চৌধুরীর সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধায়ক,সঙ্গী। মাহমুদ আলম সৈকত সূত্রে আমারও বন্ধুপ্রতিম বড়ো ভাই। রমা চৌধুরীর সমস্ত বই প্রকাশ করতেন তিনি। সে-সুবাদে প্রেসপাড়া পরিচিত ছিল। তিনি নিয়ে গেলেন আন্দরকিল্লা মোড়ে কোহিনূর প্রেসের পাশেই মিলেনিয়াম কম্পিউটারে। রণতোষ ধর কম্পোজ করতেন। ছোট্ট একটা অফিসকক্ষে পিছনে পেট বের হয়ে থাকা সারে-সারে কম্পিউটারগুলোতে সারাদিনরাত খটাখট শব্দে কম্পোজ চলত। ফেব্রুয়ারি হচ্ছে বইমেলার মাস। বই-কাগজ সব বিক্রির ভরা মৌসুম। সে-মাসের মধ্যেই বের করা না গেলে তো চলবেই না।
ঢাকা বাংলা একাডেমির বইমেলায় বহেরা তলায় ছিল লিটলম্যাগ চত্বর। ‘শালুক’ সম্পাদক ওবায়েদ আকাশকে বলে রেখেছি, “প্রকাশমাত্রই আমি কুরিয়ার করে দেব, আপনি শুধু কাগজগুলো রাখবার ব্যবস্থা করবেন”। এদিকে পৃষ্ঠাবিন্যাস হয়ে গেল, তার খরচা সাধ্যের মধ্যেই ছিল। কাগজ, প্লেট এসব কিনবার আর সামর্থ্য নেই। আবার ফেব্রুয়ারি মাস বলে ছাপাবার জন্য প্রেস ফাঁকা পাওয়া যাচ্ছে না।
এর ফাঁকেই রাত জেগে প্রুফ দেখছি, প্রিন্টার্স লাইন রেডি করছি। একটা হুলুস্থূল সময়। কিন্তু পয়সা তো লাগবে সবার আগে। বিজ্ঞাপন নেবার পরামর্শ দিল অনেকে, সময় নেই। ছোটো কাগজের সাথে বিজ্ঞাপন নেবার আদর্শগত যে-দ্বন্দ্বের জায়গা তা নিয়েও ভাবার সময় নেই। অগত্যা মা-ই ভরসা। মা-কে কথা দিলাম পত্রিকা বিক্রি করে পরিশোধ করে দেব। টাকা পাবার আনন্দে মা-কে সালামও করে ফেললাম, যে-রেওয়াজ খুব একটা ছিল না ঘরে। ঠিক এইরকম ঘটনাগুলো বোধহয় সব ছোটো কাগজ সম্পাদক, তরুণ চলচ্চিত্র-নির্মাতাদের বেলাতেই প্রথম দিকে একবার ঘটে।
নারী-সম্পাদক হিসেবে আলাদা ঘটনা কিছু নিশ্চয় আছে, সেটা নিজে অনুভব করতে না-চাইলেও চারপাশের নানা অবাক দৃষ্টি বুঝিয়ে দিত একটা কিছু অস্বাভাবিকতা চলছে। সবচেয়ে বেশি অবাক হত বড়ো বড়ো ফোল্ডিং করা প্লেটগুলো হাতে যখন ছাপাখানায় ঢুকে যেতাম। একবিংশ শতকে এই বিস্ময় থাকবার কথা ছিল না। মেশিন রুমে কাজ করা ছেলে-ছোকরারা আশ্বস্ত হত আমার ঘাড়ের উপর দিয়ে কখনো মাহমুদ আলম সৈকত বা আলাউদ্দিন খোকনের মতো পুরুষ কাউকে দেখে। এরকম উপরিতলের বিস্ময়, হতবাক, হীন, কৌতুক-আমোদি দেখাগুলো নিয়ে অভ্যস্ততা ছিল। ধাক্কাটা অন্য জায়গা থেকে লাগল।
প্রথম সংখ্যাটা বেরিয়ে যাবার পর দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া পেয়েছিলাম। বুদ্ধিজীবী মহল থেকে উঠে আসা বক্তব্য ছিল এমন, এটা কী ধরনের লিটল ম্যাগাজিন হল, এত বড়ো বড়ো ফন্ট! কয়টা গল্প-কবিতা ছাপিয়ে দিলেই সম্পাদনা হয়ে গেল! আবার অনেকেই এত প্রশংসা করতে থাকল কাগজটি হাতে নিয়েই নাকি একটা নরম-কোমল অনুভূতি হচ্ছে, অনেকদিন পর চট্টগ্রাম থেকে একটা সুন্দর কাগজ হয়েছে বলে। ইতোমধ্যে ঢাকা বইমেলা থেকেও ঘুরে এসেছি। আগ্রহভরে উলটেপালটে দেখেছে সবাই, কিনেছেও অনেকে। অবাক বিস্ময়ে শুধু লক্ষ করলাম অনেকদিন অতিবাহিত হবার পরও একজন পাঠকও পাইনি যিনি বলেছেন ‘ঘুড়ি’তে প্রকাশিত আহমাদ মোস্তফা কামালের ‘মধ্যবিত্তের পরিচয় চিহ্ন’ লেখাটি খুব চিন্তার উদ্রেক করে, প্রশান্ত মৃধার নতুন একটি গল্প পেলে কী করে, আহমেদ মুনিরের ‘প্রতিবেশী’ গল্পটি কিংবা শিল্পী মনসুর উল করিমের নেয়া অন্তরঙ্গ সাক্ষাৎকারটি নিয়ে কিছু বলেছেন! আর কিছু না-হোক, পাকা কবিদের পাশে সে-সংখ্যায় প্রথম কবিতা ছাপা হয়েছে এমন কবিতা নিয়েও বলা তো যেত! সমাজের দেখা চোখের অভ্যস্ততা এ-জায়গায় এসে ধাক্কা খেল।
514403105_10163049415234382_7635488789376157413_n
সচেতন মানুষের নির্লিপ্ততা ও উপরিতলের দেখায় ভরসাহীন না-হয়ে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু হলো ‘ঘুড়ি’র। ভেবে ফেললাম, লোকে পড়বে না, লোকে ভেবে মূল্যায়নের কাজ করবে না; তাই বলে থেমে থাকলেও চলবে না। লোকের জন্য নয়, সাহিত্যের সাথেই নিবিড় করে যুক্ত থাকা হবে সম্পাদনা চালিয়ে গেলে।
ভাবনা-চিন্তার পরিসরটি প্রতি সংখ্যায় পরিবর্তিত ও বড়ো হতে থাকল একটু একটু করে।
‘চর্যাপদ’ নামে শুধু কবিতা নিয়ে পকেট সাইজ কাগজ বেরুত চট্টগ্রাম থেকে। দামও অল্প হওয়ায় তুমুল জনপ্রিয় ছিল। সে-সময় ‘চর্যাপদ’-এর সম্পাদনা পর্ষদে ছিল এক ঝাঁক মেধাবী তরুণ কবি। সাইদুল ইসলাম, নায়েম লিটু, চন্দন চৌধুরী, অঞ্জন সরকার জিমি, ফুয়াদ হাসান। এবং পরে যুক্ত হল মুয়িন পারভেজ, মেরুন হরিয়াল। সম্পাদনা পর্ষদ ছাড়াও চর্যাপদ কেন্দ্রিক একটা আড্ডা তৈরি হল। আড্ডা কেন্দ্রের গুরুভাগে থাকতেন শরীফা বুলবুল লাকী। লাকী আপা ‘বলাকা’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করতেন। হুমায়ুন আজাদকে নিয়ে একটি বিশেষ সংখ্যার কথা মনে আছে এখনো। ‘চর্যাপদ’-এর আড্ডা বসত কদম মোবারক মার্কেটে লাকী আপার ‘বলাকা’ অফিসে। টাটকা সব কবিতা শুনে, পড়ে ও লিখে একটা বেশ দিন যাচ্ছিল। প্রতিদিন কবিতা লেখার চেষ্টা করতাম; অন্তত আমরা তিনজন সাইদুল, মুয়িন ও আমি। না-লিখলে দেখা হওয়াটাই অনেক পানসে লাগত। কবিতা শোনার পর একে অন্যের পাঠ প্রতিক্রিয়ার জন্য উৎসুক হয়ে থাকতাম। মনে আছে প্রতিক্রিয়া কখনো বাহ, সুন্দর—এইসব বিশেষণে আটকে থাকেনি। এক বিকেলে আমরা নৌকায় চড়ে কর্ণফুলি নদীতে ঘুরতে বেরুলাম। মাঝ নদীতে সেলিম মাঝিকে বললাম, “ভাই ইঞ্জিন থামিয়ে একটু বিশ্রাম নিন না!” উদ্দেশ্য নীরবতাকে উপলব্ধি করা। কথামতো রাতে ফিরে সেদিনের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনজনই তিনখানা কবিতা লিখে ফেললাম। এই চর্চা লেখালেখিকে সমৃদ্ধ করেছিল নির্দ্বিধায় বলা যায়। আমাদের এইসব আড্ডার বিষয়বস্তু ‘ঘুড়ি’-সম্পাদনার ক্ষেত্রেও প্রভাব রেখেছিল।
পরের বছর দ্বিতীয় সংখ্যায় গল্প, কবিতা, বিভিন্ন বিষয়ে প্রবন্ধ, চিত্রকলা, সংগীত, অনুবাদ সাহিত্য এসব নিয়মিত আয়োজনের সাথে লিটলম্যাগ আলোচনা ও পার্বত্য চট্টগ্রামের লোকশিল্প সংযোজিত হল।
2.1
শেষ সংখ্যার প্রচ্ছদটি করে দিয়েছিলেন কবি ও চিত্রকর খালিদ আহসান। তারও আগে মোটামুটি তিন নম্বর সংখ্যা থেকেই খালিদ ভাই যুক্ত ছিলেন ‘ঘুড়ি’র সাথে। কদম মোবারক মার্কেটের নিচে প্রেস গলিতে কোনো এক দুপুর বেলায় বসেছিলেন চালু মেশিনের সামনে। ছাপা চলছিল কিছু। চেরাগি পাহাড় মোড়েই বিজ্ঞাপন প্রতিষ্ঠান গ্রাফিতির অন্যতম পরিচালক ছিলেন তিনি। আমাকে ওই অঞ্চলে দেখে এটাসেটা অনেক কিছু জানতে চাইলেন। বেশি কিছু বলতেও হল না; প্রচ্ছদ ও লিটল ম্যাগাজিন জগতে আশির দশকের এক উজ্জ্বল নাম খালিদ আহসান। ওই আলাপের পর উনি নিজে গ্রাফিতির বিজ্ঞাপন দিলেন, এবং আশ্বাস দিলেন উনার পরিচিত-মণ্ডলকে এ-বিষয়ে কাজে লাগাবেন। আশ্বাস মনে রেখেছিলেন। বিজ্ঞাপনের পয়সা হয়তো পাওয়া যেত না সবসময়, কিন্তু যে জন্য কৃতজ্ঞ ছিলাম প্রচ্ছদ ও বিজ্ঞাপন মিলিয়ে শেষ চার পাতার দায়িত্ব উনি নিয়ে নিতেন। সে-সমস্ত সংখ্যায় কী যে নিশ্চিন্ত লাগত! একটা প্রচ্ছদে লুসিফার লায়লার একটি চিত্রকর্ম ব্যবহার করলাম। সমালোচনা সাহিত্য সংখ্যায় শিল্পী ইয়াসমিন জাহান নূপুরের একটি চিত্রকর্মও বেশ নজর কেড়েছিল। এই করে করে সকলের যোগে সম্পাদনার মালাটি গাঁথা হত।
‘ঘুড়ি’—এরপর আর প্রকাশিত হয়নি। কারণ হিসেবে বলা যায়, একটা নিভৃত ক্লান্তি ছিল। এছাড়া মনে হল সৃষ্টির মৌলিক-আনন্দ থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। একেকটি সংখ্যার পরিকল্পনা করতে-করতে, একটা ভালো লেখার জন্য তাগাদা দিতে-দিতে, লেখকদের কাছে পৌঁছাতে-পৌঁছাতে, পয়সা জোগাড় করতে-করতে বছর ঘুরে যেত। তবে প্রাপ্তি হল এই, অনেকদিন পর কারো সাথে দেখা হলেই যখন বলে, “ঘুড়ি কি আর বের হবে না?”
এরপর কবিতায় মন দিলাম। কবিতায় যে ইমেজ রচনা করি, সে-ইমেজ ক্যামেরার চোখ দিয়ে দেখতে শুরু করি। আলোকচিত্র আর চলচ্চিত্র জীবনে খুব দখল করে বসল। এরপর সম্পাদনাও শুরু করলাম গত বছর থেকে। এবার অনলাইন মিডিয়ায়। ‘চিত্রসূত্র’ নামে ইমেজ নির্ভর শিল্পপত্রিকা। জড়িয়ে গেলাম আরও অনেক কিছুতে, সবই মনের আনন্দে। পাওয়ার হিসেব সামনে এলেই পথ পিচ্ছিল হয়। বিশাল সমুদ্রের জলরাশি যেমন সুন্দর, বাড়ির কাছের জলাশয়ও সুন্দর। দুটোতেই জল আছে, মিলিয়ে দিতে হয়। মেলবন্ধনের, মালা গাঁথার কাজটাই সম্পাদকরা করেন। সম্পাদনার টেবিলে শেষ লেখাটি পৌঁছে না-যাওয়ার আগ-মুহূর্তের লোমহর্ষক সময়টিই হয়তো তীব্র বেঁচে থাকা।

সৈকত মুখার্জি সম্পাদিত, হরপ্পা, সপ্তম বর্ষ প্রথম সংখ্যায় মুদ্রিত (অক্টোবর ২০২৩)

মানবিক বেদনার শিল্পভাষা: ক্যেথে কোলভিৎস

মানবিক বেদনার শিল্পভাষা: ক্যেথে কোলভিৎস

তিনি ক্যেথে কোলভিৎস। পৃথিবীর অন্যতম মহৎ ও উচ্চমার্গীয় একজন শিল্পী হওয়া সত্ত্বেও, যার নাম তেমনভাবে উচ্চারিত হয় না বা আজ অবধি আমরা অনেকেই তেমনভাবে জানি না। তাঁর সময়কালেই শিল্প ইতিহাস ছিল সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় এবং রূপান্তরের। এক্সপ্রেশনিজম, স্যুররিয়ালিজম, ফভিজম, কিউবিজম, রিয়ালিজম, লোকধর্মী কাজ, ব্যঙ্গচিত্র ইত্যাদি নানা ধারা তখন বিকশিত হতে শুরু করে। এই সময়েই ইউরোপজুড়ে নানা আন্দোলন, যুদ্ধ, শিল্পবিপ্লব ও নতুন নতুন ধারার জন্ম হয়েছে। এই সময়েই ম্যাক্স বেকম্যান, পল ক্লি, ক্লোদ মোনে, অঁরি মাতিস, পাবলো পিকাসো, মার্ক শাগাল, দিয়েগো রিভেরার মতো দুনিয়ার সব তারকা শিল্পীদের উত্থান ঘটে। আর এর মধ্যে কোলভিৎস যেন একাই এক মানবিক ধারার জন্ম দিয়ে ফুটে উঠেছিলেন একটু দূরে, আবছায়ায়, মেঘঢাকা একটি একক তারা হয়ে।
সেসময় তাঁর চারপাশে উচ্চবিত্ত ও শ্রমজীবী সমাজের ব্যবধান ছিল অনেক বেশি, দ্রুত শিল্পায়ন বাড়ছিল আর শ্রমিকদের অবস্থা হচ্ছিল করুণতর; নারী অধিকারের প্রশ্ন ছিল অনুপস্থিত। ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত চলে নাৎসি যুগ যখন হিটলার ক্ষমতায়। আর তখন সমাজতন্ত্রী ও শান্তিবাদী শিল্পীদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। আর শিল্পী তখন এঁকে চলেছেন শ্রমিক বিদ্রোহ, দারিদ্র্য ও নারীর দুর্দশা। প্রোলেতারিয়েতের সঙ্গে জোরালো এক আবেগপূর্ণ সম্পর্কই কোলভিৎসের কাজের অন্যতম প্রধান সদ্গুণ।
ক্যেথের নিজেরই বয়ান, “বহুকাল ধরে আমার যাবতীয় প্রধান কাজের বিষয়বস্তু কেন শুধু শ্রমিকদের জগৎ থেকে আরোহিত হত, তার কারণ খুঁজে পাওয়া যাবে শ্রমিকঅধ্যুষিত আমাদের এই ব্যস্ত, ব্যবসাপ্রধান শহরের সরু সরু গলিরাস্তায় আমি যে দীর্ঘ সময় পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়াতাম, তার মধ্যে। সেই সময় থেকেই প্রধানত শ্রমিকদের জীবন থেকে উপাদান বেছে নিতে শুরু করি। এর আসল কারণ, সেই পরিমণ্ডলের সবকিছুই আমার কাছে খুব সহজ ও অকৃত্রিম সুন্দর বলে মনে হত। সুন্দর মানে আমার কাছে কোনিগসবের্গের কেউ যখন ভারী মাল বইছেশ্রমজীবীর প্রাণবন্ত শরীরগতির চেয়ে সুন্দর আর কী হতে পারে? মধ্যবিত্তরা আমাকে আদৌ আকর্ষণ করে না। তাদের পুরো জীবনটাই মনে হয় পুথিসর্বস্ব, অন্যদিকে প্রোলেতারিয়েত জীবনে আছে বিশাল শক্তিস্রোত।
Käthe Kollwitz
(1867-1945)
Käthe Kollwitz (1867-1945)
‘মজার একটি ব্যাপার হলো—ক্যেথের শিল্পকর্মের প্রেরণা বেশিরভাগই এসেছে সাহিত্য ও নাটকের নানা উপাদান থেকে।’
সেই শক্তিস্রোতের প্রমাণ মেলে ১৮৯৩ থেকে ১৮৯৭ পর্যন্ত করা তাঁর ‘দ্য উইভার্স’ (The Weavers) সিরিজের কাজগুলোতে। ‘মার্চ অব দ্য উইভার্স’—পদযাত্রার ছবিটিতে (ছাপচিত্র) শ্রমিকের বিষণ্ন ক্লান্ত সারিসারি মুখ দেখতে পাই, যেখানে নারীর পিঠে ঘুমিয়ে পড়া শিশুও আছে। তারা হাঁটছে অনিশ্চয়তার দিকে, কিন্তু চোয়াল মজবুত, আর পদক্ষেপ সুদৃঢ়। বড় কোনো বক্তব্যকে উচ্চকিত না করেও, অল্প বাল্বের আলো আর চারপাশের বিষণ্নতাকে পুঁজি করে দুজন তাঁতী টেবিলের দুই প্রান্তে বসে গল্প করে—সিরিজের এই ছবিটি একান্ত নিজস্বতা নিয়ে বসে থাকে নির্জন। ১৮৪৪ সালে সাইলেশিয়ান তাঁতীদের বিদ্রোহকে ভিত্তি করে মোট ৬টি প্রিন্ট—তিনটি এচিং ও তিনটি লিথোগ্রাফ—একত্রে এক বিশাল বয়ান তৈরি করে, যার মূল বিষয় সর্বহারার সামাজিক বঞ্চনা, বিপ্লবী প্রতিবাদের মূল মানস এবং মৃত্যু। শ্রমিকশ্রেণির সামাজিক অবস্থার সুস্পষ্ট সমকালীন ইঙ্গিতের ফলে এ কাজের প্রাসঙ্গিক গুরুত্ব পরিষ্কারভাবেই আরো বেড়ে যায়।
Storming The Gate
“এক মায়ের ছবি এঁকেছি, সে তার মৃত পুত্রকে কোলে নিয়ে আছে। এরকম শত শত ছবি আঁকতে পারি, কিন্তু তবুও তার কোনোটাই আমায় ওর কাছে নিয়ে যাবে না।”
মজার একটি ব্যাপার হলো—ক্যেথের শিল্পকর্মের প্রেরণা বেশিরভাগই এসেছে সাহিত্য ও নাটকের নানা উপাদান থেকে। সৃষ্টির প্রথম প্রেরণা এসেছিল ফরাসি খনি শ্রমিকদের জীবনী নিয়ে লেখা এমিল জোলার উপন্যাস ‘জার্মিনাল’ পড়ে। তারপর একে একে হাউপ্টমান, ম্যাক্স হালবের নাটক তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। আধুনিক লেখকদের মধ্যে যাঁরা তাঁর সৃষ্টিকে প্রভাবিত করেছিলেন—ইবসেন, আর্ন গারবোর্গ, তলস্তয়, দস্তয়েভস্কি, গোর্কি, গেরহার্ট, আর্নো হোলজ, জুলিয়াস হার্ট, কবি ফের্ডিনান্ড ফ্রিলিগ্রাথ প্রমুখ। তবে তাঁর কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন গ্যেটে। প্রচুর সৃজনশীলতার অধিকারী না হলে মানসিক অভিজ্ঞতা এভাবে অনুপ্রাণিত করতে পারে না। সমসাময়িক শিল্প-সাহিত্য ছাড়াও প্রতিদিনের রাজনৈতিক ঘটনা এবং সর্বতোভাবে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় তাঁর কৌতূহল ও উৎসাহের মাত্রা তীব্র ছিল।
ক্যেথের জীবন ও শিল্পের সবচেয়ে হৃদয়বিদারক অধ্যায়টি প্রকাশ পায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ১৮ বছর বয়সী ছেলে পিটারকে হারানোর পর। ছেলের মৃত্যু তাঁকে যুদ্ধের ঘৃণ্য বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করায়। বাস্তবিকপক্ষে এই আঘাত থেকে তিনি কখনোই আর সেরে ওঠেননি—তা প্রতিভাত হয় পরবর্তী সময়ের কাজগুলোতে। বেলজিয়ামের মাটিতে ছেলের কবরের ওপর স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের পরিকল্পনা নেন। কালক্রমে গড়ে ওঠে যুদ্ধে নিহত মনুষ্যত্বের শ্রেষ্ঠ অংশ—যৌবনের উদ্দেশে নির্মিত সেই গভীর মর্মস্পর্শী স্মারকস্তম্ভ—‘আর যুদ্ধ নয়’-এর সংকল্পের দৃঢ় ঘোষণা। বিশাল গ্রানাইট স্তম্ভ নির্মিত হয় ১৯৩২ সালে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার সাত বছর আগে। এই মৃত্যু ও যুদ্ধের ভয়াবহ বাস্তবের সঙ্গে তাঁর বোঝাপড়ায় আসার সংগ্রাম অসংখ্য ছবি ও প্রিন্টে ছড়িয়ে আছে।
তিনি লিখেছেন, “এক মায়ের ছবি এঁকেছি, সে তার মৃত পুত্রকে কোলে নিয়ে আছে। এরকম শত শত ছবি আঁকতে পারি, কিন্তু তবুও তার কোনোটাই আমায় ওর কাছে নিয়ে যাবে না।”
Nie wieder Krieg (Never Again War)
আগস্ট ২২, ১৯১৬ সালে লিখেছেন, “যখন খুব শুকিয়ে উঠি, তেষ্টা পায়, সেই দুঃখই যেন কামনা করি আবার। কিন্তু যখন তা ফিরে আসে, কাজের জন্য দরকারি শক্তি আর থাকে না, সব কেড়ে নেয় শোক… কাজের মধ্যেই আছে পিটার, হয়তো ওকে আমি সত্যিই ফিরে পাব। না, তা-ও যেন বিশ্বাস করতে পারছি না, খুব ভেঙে পড়েছি, অসুস্থ, আমার চোখের জলে ধুয়ে যাচ্ছে সময়। আমি যেন টমাস মান-এর সেই লেখক, যে শুধু লিখতে পারে, যা কিছু লেখা হল, তার মধ্যে বেঁচে থাকার শক্তি নেই তার। একটাই তফাৎ, আমি ভাষাও হারিয়ে ফেলছি। কোন প্রতিভাধরের পক্ষে সম্ভব হতে পারে, আমার দ্বারা হবে না এ কাজ। কাজের জন্য কঠিন হতে হয়, স্থূল জীবনের যা কিছু, তার বাইরে যেতে হয়। যখনই ভাবছি সে-কথা, ভুলতে পারছি না যে আমিও এক মা, যার ছেলে মারা গেছে যুদ্ধে। মাঝে মাঝে সব কিছুই এত কঠিন হয়ে আসে…”
১৯২০ সালে উপবাসী ভিয়েনার জন্য সাহায্যের আবেদন জানিয়ে একটি পোস্টারে কাজ করার সময়ে লিখেছেন:
“আমি মৃত্যুই আঁকতে চাই। মৃত্যু তার ক্ষুধার চাবুক মারছে নির্বিচারে নারী-পুরুষ-শিশুর এই দীর্ঘ মিছিলে… যখন বসে বসে শিশুদের দুর্দশার ছবি আঁকতাম, তা আমায় ওদের সঙ্গে কাঁদিয়ে ছাড়ত এবং যে ভার আমাকে বহন করতে হবে তার কথা তীব্রভাবে স্মরণ করতাম। বুঝতে পারতাম, সমর্থন প্রত্যাহার করার কোনো অধিকার আমার নেই, সে-ই আমার নিদ্দিষ্ট কাজ। মানুষের যন্ত্রণা আমাকে দেখতেই হবে। তার কোনো শেষ নেই, আর এখন তা পাহাড়ের মতো জমে উঠেছে, পথ আটকে।”
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অনেক আগে থেকেই ক্যেথে পোস্টার আঁকতে শুরু করেন। ১৯০৬-এ আঁকা একটি পোস্টারে তিনি গৃহশ্রমের ভয়াবহ ত্রাস ও তার রক্ত-ঘামের ঢাল টেনে খুলে দিয়েছিলেন। বড় শহরগুলোতে শিশুদের খেলার মাঠের সুবিধার জন্য আবেদন রেখে আরেকটি পোস্টার আঁকেন ১৯২২ সালে। তাঁর বেশিরভাগ পোস্টারই বিশের দশকের। ‘ফ্রি দ্য প্রিজনার্স’ করা ১৯১৯ সালে। ১৯২০ সালে মুনাফাখোরির বিরুদ্ধে তিনটি ব্রডশিটের আক্রমণ এবং ভিয়েনার দুর্ভিক্ষে সাহায্যের আবেদন জানিয়ে আর একটি কাজ: “ভিয়েনা মরছে, শিশুদের বাঁচাও”। ১৯২১-এ ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার্কার্স এইডের জন্য একটি পোস্টার: “হেল্প রাশিয়া!” ১৯২২-এ ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব ট্রেড ইউনিয়নের জন্য যুদ্ধবিরোধী পোস্টার: “দ্য সারভাইভর্স ডিক্লেয়ার ওয়ার অন ওয়ার।” ১৯২৪ সালেও অনেকগুলি কাজ করলেন ওদের জন্য। ১৯২৫ সালে তিনি দ্বিতীয়বারের মতো গৃহকর্মের উপর একটি পোস্টার করেন, তার পরের বছর শিশু মৃত্যুর বিরুদ্ধে প্রচার-সমর্থনে আরেকটি পোস্টার করেন। পোস্টারগুলোর বেশিরভাগই পরিকল্পিত ড্রয়িং থেকে তৈরি লিথোগ্রাফ।
Für Groß‑Berlin (For Greater Berlin)
ক্যেথের সমসাময়িক হাইনরিশ জিল শ্রমিকশ্রেণির জীবনের নিত্যকার ঘটনাবলীর কৌতুক ও কাব্য চিত্রিত করার চেষ্টা করেছেন। গেয়র্গ গ্রোস, অটো ডিক্স এবং ম্যাক্স বেকমান তাঁদের হিংস্র ব্যঙ্গাত্মক প্রিন্টে সমসাময়িক বুর্জোয়া সমাজের মাত্রাধিক উল্লাস নিয়ে উপহাস করেছেন। কিন্তু ক্যেথে কোলভিৎসই একমাত্র, যিনি সর্বদা শোষিত-নিরাশ্রয়, অনাহারে রুগ্ন ও উদ্বেগক্লিষ্ট মায়েদের পক্ষে সওয়াল করেছেন। বার্লিনের দরিদ্র শ্রমিক পাড়ার এক ডাক্তারের স্ত্রী হিসেবে তিনি শ্রম জীবনের অকথ্য দুর্দশার কথা জানতেন। শিল্পী হিসেবে তাঁর অভিপ্রায় ছিল এই অভিজ্ঞতা এমন এক বাস্তবধর্মী রূপবন্ধে প্রকাশ করা, যা তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বিশ্বাস করতেন, রাস্তার সাধারণ মানুষের জন্য কোনো রকম লঘু শিল্পের দরকার নেই। হতে পারে যে অর্থহীন তুচ্ছ কোনো কাজই তার বেশি পছন্দ, কিন্তু তিনি নিশ্চিত ছিলেন, সে আরও কিছু উপভোগ করতে পারে—ছবিও পারবে, যদি তা লঘু না-হয়েও সরল হয়। তিনি এ-ও স্থির জানতেন, যে শিল্পী ও জনগণের মধ্যে কোনো একটা বোঝাপড়া সত্যি সম্ভব। মহৎ শিল্পের ক্ষেত্রে তা-ই বারবার ঘটেছে।
পুনশ্চ: সন্দীপন ভট্টাচার্যর সংকলন ও বিন্যাসে “ছবির রাজনীতি রাজনৈতিক ছবি” নামক অত্যন্ত পরিশ্রমী ও গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থটি নিয়ে আলোচনা করব এই ছিল মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু ৩টি অধ্যায় জুড়ে থাকা শিল্পী ক্যেথে কোলভিৎস গত এক মাস জুড়ে আমায় এমন প্রভাবিত করে রেখেছে যে আর কোথাও মন যেতে পারেনি। লেখা ও ছবির উৎস এই বইখানা এবং অনলাইনে যা পেয়েছি তাই। এই লেখা পড়ে যারা ক্যেথে সম্পর্কে আগ্রহী হবেন, তাঁদের অনুরোধ করব বইটি সংগ্রহ করে পড়ে নিতে। কারণ বাংলায় এরকম বিষয় নিয়ে বই আর দ্বিতীয়টি নেই।